স্বামী অখণ্ডানন্দের কৃষি ভাবনা।
বিশ্ববিজয়ী স্বামী বিবেকানন্দের মতাে তার গুরুভাই স্বামী অখণ্ডানন্দও বিখ্যাত পুরুষ। তিনিই প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গে সেবাধর্মের সূচনা করেন। ১৮৯৭ সালে মুর্শিদাবাদের সারগাছি-মহুলা অঞ্চলে তিনি স্থাপন করেন রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম শাখা। হিমালয়ে যাওয়ার পথে সেখানকার দুর্ভিক্ষ দেখে সেখানেই থেকে গিয়ে সেবাকাজ শুরু করেন।![]() |
| স্বামী অখণ্ডানন্দের কৃষি ভাবনা। |
১৯১৩ সালের মাঝামাঝি সারগাছি স্টেশনের অদূরে স্থাপন করলেন স্থায়ী আবাস। উলুখড়ে ভরা জমিটি তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সবুজ বাগান ও কৃষিক্ষেত্রে পরিণত হলাে। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের সেবা করতে এসে তৈরি করলেন এক স্বর্গীয় অন্নসত্র। সেই প্রতিষ্ঠান আজ কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। জমি কেনার পর দণ্ডী মহারাজ ( স্বামী অখণ্ডানন্দ সারগাছি অঞ্চলে এই নামে পরিচিত ছিলেন) তার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশটিকে প্রথমে চাষ-আবাদ করতে উদ্যোগী হলেন। উদ্যোগী হলেন পুষ্পেদ্যান সাজাতেও। প্রাণপ্রিয় গুরুভাই স্বামী বিবেকানন্দ যেহেতু গােলাপ পছন্দ করতেন তাই। নানান রংয়ের গােলাপের বাগান তেরি করে ফেললেন। আবাসিক অনাথ ছাত্রদের নিয়ে তৈরি করলেন সবজি বাগান। স্থায়ী জমি তৈরি হবার আগে যে যে জায়গায় ছিলেন সেখানেও উদ্যান রচনা করিয়েছেন।
১৮৯৮ সালে তার মনের ইচ্ছা প্রমদা দাস মিত্রকে চিঠিতে লিখেছেন, “আমার আন্তরিক ইচ্ছা যে, এই অনাথ আশ্রমটি সেল্ফ সাপাের্টিং হয়। অনাথ বালকদিগের দ্বারা উত্তমরূপে আবাদ করাইতে পারিলেই, আশ্রমস্থ বালকগণের শ্রমলব্ধ ধনেই আশ্রমের ব্যয় নির্বাহ হইতে পারিবে।” তিনি অনাথ বালকদের পড়াশুনার পাশাপাশি দর্জির কাজ ও কাপড় বােনার কাজ শিখিয়েছিলেন। ১৮৯৮ সালে আশ্রমে মােট ১১ জন অনাথ বালক ছিল।
সারগাছি মিশনের প্রথম অধ্যক্ষ স্বামী অখণ্ডানন্দের লেখা ৬৫০ টি চিঠি অনুধ্যান করলে দেখা যায়, তিনি। আশ্রমের কাজকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিতেন। বেলুড় মঠের নির্দেশিত কাজকর্ম ছাড়া তিনি আশ্রম ছেড়ে থাকতে চাইতেন না। এমনকী তিনি কৃষি মরশুমে মনােরম তীর্থক্ষেত্র ও নিসর্গ-নিবিড় ভ্রমণের অনুরােধও প্রত্যাখ্যান করেছেন। এলাকায় কৃষির উন্নয়নের জন্যও তিনি সক্রিয় থাকতেন। ছায়াবাজি বা ম্যাজিক লণ্ঠনের মতাে ভিস্যুয়াল স্লাইড তৈরি করে আধুনিক কৃষিকাজে কৃষকদের সচেতন করতেন। আজকের বেলডাঙ্গা, ভাবতা, সারগাছি, বলরামপুর অঞ্চলে সবজি, পাট এবং তৈলবীজ চাষের যে ব্যাপক বিস্তার তার অনুপ্রেরণা স্বামী অখণ্ডানন্দ চিত।
তার চিঠিপত্র পড়ে দেখা যায়, আশ্রমে চাষের জন্য তিনি মায়াবতী থেকে বড়াে জাতের কুমড়া, বরবটি ও শিমের বীজ, তৎকালীন পূর্ববঙ্গের আমিনপুর ও ঢাকা থেকে ভালাে জাতের ওলের বীজ, গােয়ালন্দ থেকে তরমুজের বীজ, কলকাতার নার্সারি থেকে তরমুজ, বিট, শালগমের বীজ এবং ময়মনসিংহ থেকে বেগুনের বীজ আনিয়েছিলেন।
এক সময় রাজ্য কৃষি উন্নয়ন আধিকারিক হিসেবে আমার পােস্টিং ছিল বহরমপুর ডালশস্য ও তৈলবীজ গবেষণা কেন্দ্রের বেলডাঙ্গা উপ গবেষণা কেন্দ্রে। সেসময় সারগাছি, মিশনের প্রধান ছিলেন স্বামী অনাময়ানন্দজী মহারাজ। তার সম্মতিতে আমি সারগাছি আশ্রমে থাকার সুযােগ পাই। তখন আশ্রমের বালকদের পড়াতাম ও কৃষিকাজ দেখাশুনা করতাম। প্রায় একবছর সেখানে থেকে আশ্রমের দিব্য পরিবেশ লাভের ও গ্রামবাসীদের কৃষি-কৃষ্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার সুযােগ পাই। সারগাছি তপােবনে বসবাস আমার এ জীবনের একটি স্মরণীয় তপস্যাকাল।
লেখকঃ ড. কল্যাণ চক্রবর্তী


0 Comments