পাথুরিয়াঘাট মল্লিক বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবসমাধি উৎসব।
১৮৮৩ সালের একুশে জুলাই বাংলা শ্রাবণ মাস শুক্লা চতুর্দশী। প্রাক পূর্ণিমার সন্ধ্যায় জ্যোৎস্নালােকিত প্রকৃতি। একটা গাড়ি এসে থামল উত্তর কলকাতার ৬৭ নম্বর পাথুরিয়াঘাট স্ট্রিটের বাড়ির সামনে। গাড়ির মালিক অধরলাল সেন। তৎকালীন দাপুটে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। আরােহীদের মধ্যমণি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস সঙ্গে তার কয়েকজন অন্তরঙ্গ পার্ষদ। যে বাড়িতে তাঁরা এলেন, সেই বাড়ির কর্তা যদুলাল মল্লিক। ঠাকুরের আগমনের উদ্দেশ্য, মল্লিক পরিবারের কুলদেবতা দেবী সিংহবাহিনী দর্শন।![]() |
| পাথুরিয়াঘাট মল্লিক বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবসমাধি উৎসব। |
এবার মল্লিক পরিবারের গৃহস্বামী যদুলাল মল্লিকের কিছুটা পরিচয় জেনে নেওয়া যাক। মল্লিক পরিবারের আদিপুরুষ ১ মতিলাল মল্লিক ছিলেন অপুত্রক। তিনি যদুলাল মল্লিক (১৮৪০-১৮৯৪) কে দত্তক নিয়েছিলেন। যদুলাল প্রখ্যাত বাগ্মী, সাবেক কলকাতা পুরসভার কমিশনার, তদানীন্তন কলকাতা। শহরের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। এ তাে গেল তার বাহ্যিক পরিচয়। যদুলাল ছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের একজন ঘনিষ্ঠ গৃহী পার্ষদ।
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে আবার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে চলে আসি। শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের নিয়ে ঠাকুরদালানে দেবী সিংহবাহিনীর পূজার স্থানে এলেন। চন্দন ফুল ও মালায় দেবী যেন চিন্ময়ী রূপে আবির্ভূত। দেবী মূর্তির সামনে কৃত্রিম আলাের ঔজ্জ্বল্য। টাকা পয়সা ঠাকুরের কাছে ব্রাত্য, আবার । দেবী দর্শনে এলে প্রণামী দিতে হয়। একজন ভক্তকে বললেন, টাকা দিয়ে প্রণাম করতে।
শ্রীরামকৃষ্ণ সিংহবাহিনীর সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকক্ষণ ধরে তিনি তন্ময় হয়ে মাকে দর্শন করছেন। এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় শ্রীরামকৃষ্ণ একেবারে সমাধিস্থ হয়ে গেলেন। সমাধিস্থ শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্য প্রভায় সেদিন (১৮৮৩ সালের ২১ জুলাই) পাথুরিয়াঘাট মল্লিক বাড়ির ঠাকুরদালান হয়েছিল বিভূষিত।
অবিকল পাথরের মূর্তির মতাে তিনি নিস্পন্দ নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, অপলক নয়নে। ভক্তরাও দেখছেন সেই দৃশ্য। এভাবেই অতিবাহিত হলাে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর একসময় শ্রীরামকৃষ্ণ দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। তার সমাধি ভঙ্গ হলাে। কেমন যেন নেশায় মাতােয়ারা তিনি। সিংহবাহিনীর উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘মা, আসি গাে’।
দেবী দর্শনের পরে তিনি চললেন গৃহকর্তা যদুলাল মল্লিকের বৈঠকখানায়। ভক্তরাও তাকে অনুসরণ করলেন। বৈঠকখানায় যেতে যেতে ঠাকুর নিজের মনে বলছেন, “মা, আমার হৃদয়ে থাক মা’। ভাবে মগ্ন শ্রীরামকৃষ্ণ বৈঠকখানায় ঢুকে। গান শুরু করলেন, “মাগাে আনন্দময়ী আমায় নিরানন্দ করাে না”। গান শেষ হলাে। ভাবােন্মত্ত অবস্থারও কিছুটা অবসান হলাে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (Sri Ramakrishna)
এবার তিনি যদুলালকে বললেন, “আমি মার প্রসাদ খাব”। মা সিংহবাহিনীর প্রসাদ এনে শ্রীরামকৃষ্ণকে দেওয়া হলাে। তিনি পরিতৃপ্তি সহকারে প্রসাদ গ্রহণ করলেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে প্রতিবছর একুশে জুলাই ৬৭ নম্বর পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটে প্রাসাদোপম মল্লিক বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবসমাধি উৎসব যথাযােগ্য মর্যাদায় উদ্যাপিত হয় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের। মহারাজবৃন্দ উৎসবে বক্তব্য রাখেন। এ উৎসবে হাজির থাকেন শহরের বিদগ্ধ ব্যক্তিরা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা অবলম্বনে গীতিআলেখ্য পরিবেশিত হয়। সামগ্রিক ভাবে, সেদিন মল্লিকবাড়ির ঠাকুরদালানে এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হয়।
লিখেছেনঃ সপ্তর্ষি ঘােষ


0 Comments