বাংলার ব্রত "অশোক ষষ্ঠী"
বাংলার লােকসাহিত্যে রূপকথা, উপকথা ব্রতকথা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। ব্রতকথাগুলিতে অন্তঃপুরে মহিলাদের দ্বারা লৌকিক দেবদেবীর উদ্দেশ্যে মহাত্মাগান রচিত হয়েছে। ব্রতকথাগুলি একসময় বাংলার লােকসমাজে খুব জনপ্রিয় ছিল। এরমধ্যে একটি হলাে ‘অশােক ষষ্ঠী ব্রত'। যেটি সাধারণত চৈত্রমাসে পালিত হয়। অনেক শিক্ষিত মহিলা এই ব্রত পালন করলেও এ সম্বন্ধে কোনও সঠিক তথ্য দিতে পারেন না।![]() |
| বাংলার ব্রত "অশোক ষষ্ঠী" |
কেউ কেউ সম্রাট অশােককে এই ব্রত প্রবর্তকের কথা উল্লেখ করেছেন, আবার কেউ অশােকবনে সীতার কথা স্মরণ করে এই ব্রতের উল্লেখ করেন। এই ব্রতের প্রাচীন কাহিনি বা প্রচলিত গল্পের কথা উল্লেখ করা হলাে।
এক আশ্রমে প্রচুর অশােক গাছ ছিল। সেই আশ্রমে এক ঋষি কুটিরে বাস করতেন। একদিন তিনি একটি অশােকগাছের তলায় একটি অতি সুন্দরী বালিকাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে পেলেন। মেয়েটির বিপদের কথা চিন্তা করে দয়াপরবশ হয়ে তিনি তাকে আশ্রমে নিয়ে এসে পালন করতে লাগলেন। অশােকতলায় পেয়েছিলেন বলে তিনি মেয়েটির নাম রাখলেন ‘অশােকা'। ক্রমে মেয়েটি অপরূপ রূপবতী হয়ে যৌবনে উপনীত হলাে। মেয়েটিকে একা আশ্রমে রেখে যাওয়া নিরাপদ নয় ভেবে তিনি পাত্রের সন্ধান করতে লাগলেন। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পেলেন না।
সেই সময় এক রাজা মৃগয়া করতে অশােকবনে উপস্থিত হলেন। তৃষ্ণার্ত হয়ে রাজা খুঁজতে খুঁজতে ঋষির আশ্রমে কুটিরে এসে জল প্রার্থনা করলেন। কুটির থেকে এক অপূর্ব রূপলাবণ্যবতী কন্যাকে দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। প্রশ্ন করে জানতে পারলেন মেয়েটি এই কুটিরের মুনির কন্যা। তার নাম অশােকা। অশােকা বলল, ‘মুনি ধ্যান করতে গেছেন, সন্ধ্যার পর ফিরে আসবেন। তখন রাজা একটি অশােকগাছের তলায় বিশ্রাম নিতে লাগলেন। সন্ধ্যার পর বেদপাঠ করতে করতে ঋষি যখন আশ্রমে ফিরছিলেন। তখন রাজা ঋষিকে প্রণাম করে হাত জোড় করে বললেন, ‘আপনি দয়া করে আপনার কন্যাটিকে দান করলে আমি তাকে বিয়ে করে রানির মর্যাদা দিয়ে নিয়ে যেতে পারি'। ঋষি মনে মনে খুব খুশি হয়ে অশােকাকে রাজার হাতে সমর্পণ করলেন।
যাবার সময় মুনি অশােকার হাত ধরে তার আঁচালে কতকগুলাে অশােকফুল ও বীচি দিয়ে বললেন, ‘মা, তুমি এই ফুলগুলাে শুকিয়ে রেখাে আর এই বীচিগুলাে রাস্তার দুধারে ছড়াতে ছড়াতে রাজধানী পর্যন্ত যাবে। রাজার বাড়ি পর্যন্ত এই বীজগুলাে থেকে অশােকগাছ জন্মাবে। যদি কোনােদিন তুমি কোনাে বিপদে পড় তাহলে ওই গাছের সারি দেখে আশ্রমে আসবে। আর অশােক ষষ্ঠীর দিনে কখনও অন্ন গ্রহণ করবে না। তুমি ষষ্ঠীকে পূজা দিয়ে ছটা অশােক কুঁড়ি, ছটা মুগকলাই, দই একসঙ্গে মুখে দিয়ে জল খাবে। গিলে খাবে, দাঁতে যেন না লাগে।
অশােকা মুনির কথামতাে বীচি ছড়াতে ছড়াতে রাজবাড়ি গেল। রাজবাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ি বউকে বরণ করে ঘরে তুললেন। রাজা অশােকাকে নিয়ে পরম সুখে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। কালক্রমে আশােকার ছয় ছেলে ও এক মেয়ে হলাে। বয়সকালে তাদের বিয়ে-থা দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি স্বর্গে গমন করলেন। রাজাও কিছুদিন পর স্বর্গে গেলেন।
চৈত্রমাসে অশােকষষ্ঠীর দিন অশােকা বৌমাদের বললেন, “আজ অশােকষ্ঠী, আমি আজ অন্ন গ্রহণ করব না। এই কথা শুনে বৌমারা তাড়াতাড়ি মুগকড়াই সেদ্ধ করে অশােকাকে খেতে দিল। নিয়ম মেনে যষ্ঠীপূজা করে খেয়ে অশােকা শুয়ে। পড়ল। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে দেখল বাই মরে পড়ে আছে। কিছু বুঝতে না পেরে সে কাঁদতে লাগলাে। কাঁদতে কাদতে অশােকার মুনির কথা মনে পড়ল। তখন সে অশােক গাছি বরার রাস্তা চিনে আশ্রমে এসে মুনিকে সব কথা খুলে বললাে। মুনি ধ্যান করে সমস্ত ব্যাপার বুঝতে পেরে অশােককে বললেন, “মা, তুমি যে মুগকলাই সেদ্ধ করে খেয়েছ, তার মধ্যে একটা ধান ছিল, সেই ধান সিদ্ধ হয়ে ভাত হয়েছে। তা খেয়েই এই বিপত্তি। ঠিক আছে আমি তােমাকে মন্ত্রপূত জল দিচ্ছি, তুমি বাড়ি গিয়ে এই জল ছিটিয়ে দিলে সবাই আবার বেঁচে উঠবে। অশােকা বাড়ি ফিরে এসে জল ছিটিয়ে দিতে সবাই উঠে বসে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল। ধীরে ধীরে সমস্ত রাজ্যে এই কাহিনি ছড়িয়ে পড়লাে। ষষ্ঠীর মহিমা শুনে সবাই ‘অশােক ষষ্ঠী’ পালন করতে শুরু করল। রাজাও সমস্ত রাজ্যে এই ব্রত পালন করতে আদেশ দিলেন। রাজ্য জুড়ে ‘অশােকষষ্ঠী পুজোর প্রচার হলাে।
বাসন্তী পূজার শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে এই পূজা পালিত হয়। তিথি অনুসারে এই ব্রত চৈত্র বা বৈশাখ মাসেও হতে পারে। এই । ব্রত পালন করলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হয় না, পুত্র-কন্যারাও শােক দুঃখ ভােগ করে না।


0 Comments